সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস (১২০৪ - ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) | | NCTB BOOK

সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি নিঃসন্দেহে খলজি মালিকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। বখতিয়ার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাংলার মুসলমান রাজ্যকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন । শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি রাজধানী দেবকোট থেকে গৌড় বা লখনৌতিতে স্থানান্তর করেন। রাজধানীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য বসনকোট নামক স্থানে একটি দুর্গ নির্মাণ করা হয়। লখনৌতি নদীতীরে অবস্থিত হওয়ায় ব্যবসা- বাণিজ্যের সুবিধা ছিল । তাছাড়া ইওজ খলজি বুঝতে পেরেছিলেন যে শক্তিশালী, নৌবাহিনী ছাড়া শুধু অশ্বারোহী বাহিনীর পক্ষে নদীমাতৃক বাংলায় রাজ্য সম্প্রসারণ সম্ভব হবে না। বাংলার শাসন বজায় রাখতে হলেও নৌবাহিনীর প্রয়োজন ছিল । তাই বলা যায় যে, বাংলায় মুসলমান শাসকদের মধ্যে ইওজ খলজিই নৌবাহিনীর গোড়াপত্তন করেছিলেন । রাজধানীর নিরাপত্তার জন্য এর তিন পাশে গভীর ও প্রশস্ত পরিখা নির্মাণ করা হয় । বার্ষিক বন্যার হাত থেকে লখনৌতি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য তিনি বহু খাল খনন ও সেতু নির্মাণ করেন। তিনি রাস্তা নির্মাণ করে সৈন্য ও পণ্য চলাচলের সুবন্দোবস্ত করেন । এ রাজপথ নির্মাণের ফলে রাজ্য শাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্যেরই শুধু সুবিধা হয়নি, বরং দেশের লোকের নিকট আশীর্বাদস্বরূপও ছিল । কারণ, তা বার্ষিক বন্যার কবল থেকে তাদের গৃহ ও শস্যক্ষেত্র রক্ষা করত ।

উপরে উল্লেখিত কার্যাবলি গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজিকে একজন সুশাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে । তিনি রাজ্য বিস্তারের দিকেও মনোনিবেশ করেন । পার্শ্ববর্তী হিন্দু, যেমন কামরূপ, উড়িষ্যা, বঙ্গ (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) এবং ত্রিহুতের রাজারা তাঁর নিকট কর পাঠাতে বাধ্য হয়। আব্বাসীয় খলিফা আল-নাসিরের নিকট থেকে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি স্বীকৃতিপত্র লাভ করেছিলেন ।
দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশ গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির অধীনে লখনৌতির (বাংলা) মুসলমান রাজ্যের প্রতিপত্তি বিস্তার কখনও ভালো চোখে দেখেননি। কিন্তু রাজত্বের প্রারম্ভে আশু বিপদ ও সমস্যার সমাধান করার পূর্বে বাংলার দিকে নজর দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি । ১২২৪ খ্রিষ্টাব্দে বিপদসমূহ দূর হলে সুলতান ইলতুৎমিশ বাংলার দিকে দৃষ্টি দেন । ১২২৫ খ্রিষ্টাব্দে মুঙ্গের কিংবা শকরিগলি গিরিপর্বতের নিকট উভয় দলের সৈন্য মুখোমুখি হলে ইওজ খলজি সন্ধির প্রস্তাব করেন। উভয়পক্ষে সন্ধি হয়। ইলতুৎমিশ খুশি হয়ে মালিক আলাউদ্দিন জানিকে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং ইওজ খলজিকে বঙ্গের শাসক পদে বহাল রে

খে দিল্লিতে ফিরে যান । কিন্তু সুলতান দিল্লিতে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইওজ খলজি পুনরায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । বিহার আক্রমণ করে সেখানকার শাসনকর্তা আলাউদ্দিন জানিকে বিতাড়ন করা হয়।

ইওজ খলজি লখনৌতি ফিরে এসেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইলতুৎমিশ আবার বাংলা আক্রমণ করবেন । তিনি প্রায় এক বছরকাল প্রস্তুতি নিয়ে রাজধানীতে অবস্থান করেন এবং পাল্টা আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করেন । এ সময় দিল্লির রাজকীয় বাহিনী অযোধ্যার বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইওজ খলজি মনে করলেন এ অবস্থায় দিল্লি বাহিনীর পক্ষে বাংলা আক্রমণ করা সম্ভব হবে না। তাই তিনি এ অবসরে পূর্ববঙ্গ আক্রমণ করার মনস্থ করেন। রাজধানী লখনৌতি একপ্রকার অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। এদিকে, সুলতান ইলতুৎমিশ পুত্র নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে লখনৌতি আক্রমণের নির্দেশ দেন। ইওজ খলজির অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বঙ্গের রাজধানী লখনৌতি আক্রমণ করেন। এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইওজ খলজি অতি অল্প সংখ্যক সৈন্য সঙ্গে নিয়ে রাজধানীতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন । শত্রুবাহিনী পূর্বেই তাঁর বসনকোট দুর্গ অধিকার করেছিল । যুদ্ধে ইওজ খলজি পরাজিত ও বন্দী হন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয় । ইওজ খলজির পরাজয় ও পতনের ফলে বঙ্গদেশ পুরোপুরিভাবে দিল্লির সুলতানের অধিকারে আসে। নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বঙ্গদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন ।

ইওজ খলজি শিল্প ও সাহিত্যের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় গৌড়ের জুমা মসজিদ এবং আরও কয়েকটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। তাঁর আমলে মধ্য এশিয়া থেকে বহু মুসলিম সুফি ও সৈয়দ তাঁর দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সমস্ত সুফি ও সুধীগণ বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচারে যথেষ্ট সহায়তা করেন । তাঁদের আগমন ও ইওজ খলজির পৃষ্ঠপোষকতায় লখনৌতি মুসলমানদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়।

ইওজ খলজির মৃত্যুর পর থেকে ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ষাট বছর বাংলা দিল্লির মুসলমান শাসকদের একটি প্রদেশে পরিগণিত হয় । এ সময় পনেরো জন শাসনকর্তা বাংলা শাসন করেন। তাঁদের দশজন ছিলেন দাস। দাসদের ‘মামলুক' বলা হয়। এ কারণে ষাট বছরের বাংলার শাসনকে অনেকে দাস শাসন বা মামলুক শাসন বলে অভিহিত করেন । কিন্তু এ যুগের পনেরোজন শাসকের সকলেই তুর্কি বংশের ছিলেন । তুর্কি শাসকদের সময়ে দিল্লিতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ চলছিল । সুতরাং বাংলার মতো দূরবর্তী প্রদেশের দিকে সুলতানদের মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল না। পরিণামে বাংলার তুর্কি শাসকরা অনেকটা স্বাধীনভাবে দেশ পরিচালনা করতেন । ১২২৯ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ মৃত্যুবরণ করলে অল্প সময়ের জন্য বাংলায় ক্ষমতায় বসেন দওলত শাহ-বিন-মওদুদ। বাংলার অর্থাৎ লখনৌতির প্রথম তুর্কি শাসনকর্তা ছিলেন নাসিরউদ্দিন মাহমুদ । তিনি ছিলেন দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশের পুত্র । ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান ইলতুৎমিশের মৃত্যু হলে দিল্লিতে গোলযোগ দেখা যায় । এ সুযোগে আওর খান আইবক লখনৌতির ক্ষমতা দখল করে নেন। কিন্তু অল্পকাল পরেই বিহারের শাসনকর্তা তুঘরল তুঘান খানের হাতে তাঁর পরাজয় ঘটে । তুঘান খান ১২৪৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নয় বছর বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন । এরপর দুই বছরের জন্য লখনৌতির ক্ষমতায় বসেন ওমর খান ।

১২৪৭ থেকে ১২৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন জালালউদ্দিন মাসুদ জানি। তিনি লখনৌতিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন । পরবর্তী শাসক ছিলেন অযোধ্যার শাসনকর্তা মালিক ইজ্জউদ্দিন বলবন-ই- ইউজবকী যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করার পর মাসুদ জানি ১২৫৫ খ্রিষ্টাব্দে 'মুঘিসউদ্দিন' উপাধি ধারণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । তিনি ১২৫৭ খ্রিষ্টাব্দে নিহত হন । পরবর্তী দুই বছর লখনৌতি স্বাধীনভাবে শাসন করেন মালিক মালিক ইজ্জউদ্দিন বলবন-ই- ইউজবকী । পরে ১২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে কারা প্রদেশের শাসনকর্তা তাজউদ্দিন আরসালান খান লখনৌতির সিংহাসনে বসেন। আরসালান খানের পর বাংলার শাসনকর্তা হন তাতার খান। তিনি দিল্লির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও কয়েক বছরের মধ্যে দিল্লির সাথে বাংলার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তাতার খানের পর অল্পদিনের জন্য বাংলার ক্ষমতার বসেছিলেন শের খান ।

পরবর্তী শাসনকর্তা তুঘরিল ছিলেন মামলুক তুর্কিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। উত্তর এবং পশ্চিম বাংলা ছাড়াও ঢাকা এবং ফরিদপুরের বেশ কিছু অঞ্চল তিনি অধিকারে আনেন। সোনারগাঁয়ের নিকট তিনি নারকেল্লা নামে এক দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। সাধারণ মানুষের কাছে দুর্গটি তুঘরিলের কেল্লা নামে পরিচিত ছিল । তুঘরিল ‘মুঘিসউদ্দিন' উপাধি নিয়ে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ফলে দিল্লির সুলতান বলবন এ বিদ্রোহের শাস্তি দিতে বাংলা আক্রমণ করেন । ১২৮১ খ্রিষ্টাব্দে বলবনের হাতে পরাজিত ও নিহত হন তুঘরিল । বাংলার শাসনকর্তারা বিদ্রোহ করেন এ কারণে বলবন তাঁর ছেলে বুঘরা খানকে বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করেন । পরবর্তী ছয় বছর বাংলা দিল্লির অধীনে ছিল। ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বলবনের মৃত্যুর পর বুঘরা খান ‘নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ' নাম নিয়ে স্বাধীন সুলতান হিসেবে বাংলা শাসন করতে থাকেন। এ সময় দিল্লির সুলতান ছিলেন বুঘরা খানের ছেলে কায়কোবাদ ।

কায়কোবাদের মৃত্যুসংবাদে বুঘরা খানের মন ভেঙে যায়। তিনি তাঁর অন্য পুত্র রুকনউদ্দিন কায়কাউসকে বাংলার সিংহাসনে বসিয়ে নিজে সরে যান । কায়কাউস (১২৯১-১৩০০ খ্রিষ্টাব্দ) দশ বছর বাংলার শাসক ছিলেন। তাঁর কোনো ছেলে না থাকায় পরবর্তী শাসনকর্তা হন মালিক ফিরুজ ইতগিন । তিনি সুলতান হিসেবে নতুন নাম ধারণ করেন ‘সুলতান শামসুদ্দিন ফিরুজ শাহ'। ফিরুজ শাহের মৃত্যু হলে পুত্র গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। অল্পকাল পরেই দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের হাতে তিনি পরাজিত ও বন্দী হন। এরপর থেকে ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা দিল্লির অধীনে ছিল । 

Content added By
Promotion